Advertise top
মুক্তিযুদ্ধ

বরিশাল মুক্ত দিবস আজ

বরিশাল নিউজ

প্রকাশ : ০৮ ডিসেম্বর ২০২৩, ০১:০০ এএম     আপডেট : ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ১০:৩২ পিএম

বরিশাল মুক্ত দিবস আজ
বরিশাল সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দেশের প্রথম সচিবালয়। ছবি: বরিশাল নিউজ

৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১। সেদিন মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে লড়াইয়ের ভয়ে বরিশাল ছেড়ে পালাতে থাকে পাক হানাদারবাহিনী। কারন ডিসেম্বরের শুরুতেই মুক্তিযোদ্ধারা বরিশালের খুব কাছাকাছি এসে পড়ে। এই খবরে আতংকিত হয়ে পড়ে পাক সেনারা। তারা সিদ্ধান্ত নেয় বরিশাল ছেড়ে পালানোর।জেলা প্রশাসকের অফিসে এই নিয়ে সভা হয়। বরিশালে পাকিস্তানের দোসর সব রাজাকার নেতারা ছিল সেই সভায়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৭ ডিসেম্বর রাতে শহরে কারফিউ জারি করে পালানোর পথ নির্বিঘ্ন করে তারা।

 

সড়ক পথ চারদিক থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রনে চলে যাওয়ার পাক হানাদাররা পালাবার পথ হিসেবে জল পথকেই বেছে নিয়েছিলো। জাহাজ  কিউসহ  একাধিক গানবোট, লঞ্চ ও কার্গো বরিশাল ষ্টিমারঘাটে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। গভীর রাতে ওয়াপদা থেকে সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া, একাধিক শান্তি কমিটির নেতা কিউ জাহাজে অবস্থান নেয় । কিউ জাহাজ বরিশাল ত্যাগ করে রাত ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে।  জাহাজের সামনে ছিলো গান বোট ও কার্গো।  অপর জাহাজটি বরিশাল ত্যাগ করেছিল ভোর ৪ টার পর। এ জাহাজেও পাকসেনা, মিলিশিয়া,শাহজাহান চৌধুরীসহ কয়েকজন রাজাকার ও দালাল ছিলো। পাকিস্তানি আর্মি  অতি গোপনে বরিশাল ঘাট ত্যাগ করে।

 

এদিকে বরিশাল শহর ছিল কারফিউর কারণে নিস্তব্ধ। হঠাৎ সেই নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে বরিশালের আকাশে উড়ে আসে যুদ্ধ বিমান। প্রথমে শহরবাসী নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিলেও কিছুক্ষনের মধ্যে তাঁরা বুঝতে পারেন এ যুদ্ধ বিমান মিত্র বাহিনীর। ভারতীয় এই বিমান বাহিনীর হামলায় পাক সেনাবাহী কিউ জাহাজসহ গানবোট ও কার্গো ধ্বংস হয়েছিলো।

 

এদিকে ৭ ডিসেস্বর সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাষ্টার তার দলবল নিয়ে নবগ্রাম রোডের চৌমাথা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। ৮ ডিসেম্বর প্রথমে তিনি বরিশাল শহরে প্রবেশ করেন। এ সময় জয় বাংলা ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বরিশাল।ঘর ছেড়ে বরিশালবাসী বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। মুক্তিযোদ্ধা সুলতান মাষ্টার কোতয়ালী থানা দখল করেন। কোতয়ালি পুলিশ তাঁর কাছে আত্মসমর্পন করে। থানায় উড়ানো হয় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

 

এরপর লাকুটিয়া রোডে অবস্থান নেয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্যগণ শহরে প্রবেশ করেন। তাঁরা প্রথমে পাওয়ার হাউস ও পরে শহর হয়ে চরকাউয়া খেয়াঘাটে বরফকলে অবস্থান নেয়।

 

গৌরনদীর বেইজ কমান্ডার নিজাম উদ্দিন হাওলাদার তার বাহিনী নিয়ে প্রবেশ করেন বরিশাল।

 

বাবুগঞ্জের বেইজ কমান্ডার আব্দুল মজিদ দুপুরের পরে বরিশাল টেক্সাটাইল মিলে ক্যাম্প গঠন করেন।

 

কুদ্দুস মোল্লা তাঁর দল নিয়ে বরিশালে ঢুকে জেলখানার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। কারাগারে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি মুক্ত করে দেন। মুক্তির স্বাদ নেয় বরিশালবাসী।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায়  “অপারেশন সার্চলাইট” এর মাধ্যমে পাকিস্তানি বর্বরবাহিনী শুরু করে গণহত্যা। ২৫ মার্চ রাতের গণহত্যার সেই খবর বরিশালে আসে টেলিফোনে।

 

২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তা বরিশাল পুলিশ লাইনের ওয়ারলেস যোগে পৌঁছে। বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট নুরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছে পৌঁছানো হয় সেই তারবার্তা। এরপরই বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। গভীর রাতে পুলিশ লাইনের অস্ত্রাগার ভেঙ্গে বিপুল সংখ্যক অস্ত্র করায়ত্ব করেন সেই সময়ের আওয়ামী লীগ নেতারা।

 

২৬ মার্চ ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের শপথ পড়িয়ে অস্ত্র হাতে তুলে দেয়া হয়। বরিশালে শুরু হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ। নগরীর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রথম দক্ষিণাঞ্চলীয় সচিবালয় গঠিত হয়। এই সচিবালয়ের মাধ্যমে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ভারত থেকে অস্ত্র আমদানি, গল্লামারির যুদ্ধ, চাঁদপুরে অস্ত্র প্রেরণ সহ বেশ কয়েকটি অপারেশন করে। এখান থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও অর্থ সরবরাহ করা হতো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষন, অন্তর্র্ভূক্তি ও ভারতে প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণের ব্যবস্থা করা হয়। এর আগে যুব সংঘের তৈরী মলোটভ ককটেল, হ্যান্ড গ্রেনেড বিভিন্ন স্থানে অপারেশনের জন্য পাঠানো হয়।

১৮ এপ্রিল পাকিস্তানি হানাদাররা আকাশ পথে বরিশালে প্রথমে হামলা চালায়। বঙ্গবন্ধু উদ্যান, মেডিকেলের সামনে, কীর্তনখোলা নদীর তীরে জঙ্গি ফাইটার দ্বারা নিক্ষেপ করা হয় বোমা। বোমায় বেশ কয়েকজন হতাহত হনয়।

 

পরে ২৫ এপ্রিল তারা জল, স্থল ও আকাশ পথে দ্বিতীয় দফা আক্রমন চালায়। স্থল পথে পাকহানাদার বাহিনী বরিশাল আসার পথে বরিশাল জেলার গৌরনদীতে প্রথম মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়। এতে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা সৈয়দ আবুল হাসেম, মোক্তার আলী, আলাউদ্দিন আহম্মদ এবং পরিমল।

 

অপর দিকে পাকিস্তানি নৌ-বাহিনী গান বোট যোগে সকাল ৯টা নাগাদ শহরে ঢোকার চেষ্টা করে। তখন শহরতলী চরবাড়িয়া ইউনিয়নের তালতলী নদীর জুনাহারে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তাদের সম্মুখে যুদ্ধ হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক একং ক্যাপ্টেন মেহেদীর নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ইরানি ও মাছবি নামে দু’টি যাত্রীবাহী ষ্টিমার নিয়ে দেশী বন্ধুক ও থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পাকিস্তানি বাহিনীর কামানের গোলায় ষ্টিমার ও লঞ্চটি ডুবে যায়।

 

পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর কয়েকটি হেলিকপ্টার থেকে শহরের উপকন্ঠে চরবাড়ীয়া ও কাশিপুরের ইছাকাঠী গার্ডেনে ছত্রীসেনা নামানো হয়। চরবাড়িয়ায় পাকিস্তানি আর্মি ঢুকে নির্বিচারে সাধারন মানুষ হত্যা করে। এখানে অর্ধশতাধিক মানুষকে তারা হত্যা করে। জ্বালিয়ে দেয় বহু ঘর বাড়ি। পাকিস্তানি বাহিনী সন্ধ্যা নাগাদ শহরে ঢুকে নির্বাচারে মানুষ হত্যা শুরু করে।

 

তথ্যসূত্র: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার।


 


মন্তব্য লিখুন


সম্পাদক ও প্রকাশক: শাহীনা আজমীন ।। স্বত্ব © বরিশাল নিউজ ২০২৪

Developed By NextBarisal